ইমাম হাসান (রা.)

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আদর্শ জীবন চরিত | | NCTB BOOK
3
3

হযরত হাসান (রা.)

হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) হলেন মহানবি (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র। তিনি আহলুল বায়ত বা নবি- পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। মহানবি (সা.) তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। চার খলিফার পরে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ খলিফা।

জন্ম ও শৈশব

হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (রা.) ও হযরত আলি (রা.)-এর ঘর আলোকিত করে ৩য় হিজরি মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে রমযান মাসে হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মে মহানবি (সা.) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আলি (রা.)-এর কাছে এসে তিনি বললেন, 'আমার নাতিকে দেখাও। তাঁর নাম কী রেখেছো?' আলি (রা.) প্রথমে নাম রেখেছিলেন, 'হারব'। মহানবি (সা.) তাঁর 'হারব' নাম বদলে নাম রাখেন হাসান। তিনি নিজেই হাসান (রা.)-এর কানে আযান দেন এবং মেষ দিয়ে আকীকা করেন। হযরত হাসান (রা.)-এর শৈশব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরম স্নেহ ও ভালোবাসায় অতিবাহিত হয়েছে। কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিজদাহ দেওয়ার সময় তিনি ও তাঁর ছোট ভাই হোসাইন (রা.) এসে পিঠে চড়ে বসতেন। তাঁরা যেন বেশিক্ষণ পিঠে থাকতে পারেন, সেজন্য তিনি নামাযের সিজদাও দীর্ঘায়িত করতেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কখনো কখনো কোলে নিয়ে হাঁটতেন। হাসান-হোসাইন দুইভাই তাঁর কাছে দৌড়ে এলে তিনি তাঁদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন। একবার তাঁরা দুজনে লাল রঙের জামা পরে বের হলেন। কিন্তু তাঁরা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহানবি (সা.) তখন খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি খুতবা বন্ধ রেখে দ্রুত নেমে এসে তাঁদেরকে উঠিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন।

আরেকবার মহানবি (সা.) হযরত হাসান (রা.)-কে কাঁধে উঠালেন। তখন একজন সাহাবি বললেন, 'হে বালক! তুমি কত উত্তম সওয়ারিতে আরোহণ করেছ।' এ কথা শুনে মহানবি (সা.) বললেন, 'আরোহী নিজেও তো কত উত্তম।' (তিরমিযি)

হযরত হাসান (রা.)- এর বয়স যখন সাত বছর, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

শিক্ষাদীক্ষা

হযরত হাসান (রা.) তাঁর নানা হযরত মুহাম্মাদ (সা.), পিতা আলি (রা.), মা খাতুনে জান্নাত ফাতিমা (রা.) প্রমুখের কাছে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি তাঁর থেকে সালাতুল বিতরের দোয়াসহ বেশ কিছু হাদিসও বর্ণনা করেছেন। একবার হাসান (রা.) সদকা হিসেবে দেওয়া একটি খেজুর মুখে দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই সেই খেজুর তাঁর মুখ থেকে বের করে আনেন এবং তাঁকে বুঝিয়ে দেন, নবি-পরিবারের জন্য মানুষের দান-সদকা গ্রহণ করা বৈধ নয়। এভাবে মহানবি (সা.) নিজেই তাঁকে তালিম-তরবিয়ত শিক্ষা দেন।

হযরত হাসান (রা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা

অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত হাসান (রা.)-এর মর্যাদা স্পষ্ট করেছেন। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, হযরত হাসান এবং হোসাইন (রা.) জান্নাতের যুবকদের সর্দার হবেন। তাঁরা দুনিয়াতে মহানবি (সা.)-এর দুটি ফুলস্বরূপ। হযরত হাসান (রা.)-এর জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন,

اللهُمَّ إِنِّي أُحِبُّهُ فَأَحِبَّهُ وَأَحِبَّ مَن يُحِبُّهُ

অর্থ: 'আল্লাহ! আমি হাসানকে ভালোবাসি। আপনিও হাসানকে ভালোবাসুন। আর যে হাসানকে ভালোবাসে, তাকেও আপনি ভালোবাসুন।' (বুখারি)

তাই হাসান (রা.)-কে ভালোবাসা আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা প্রাপ্তির অন্যতম উপায়।

বিশিষ্ট সাহাবিগণও ইমাম হাসান (রা.)-কে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর সওয়ারির রেকাব ঠিক করে দিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রা.) তাঁর কাছে বসলে অত্যন্ত শীতের রাতেও ঘেমে উঠতেন। বলতেন, 'তিনি ফাতিমার সন্তান!'

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ

মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাঁর পরে খিলাফত চলবে ৩০ বছর। আলি (রা.)- এর শাহাদতের সময় খিলাফতে রাশেদার ২৯ বছর ৬ মাস পূর্ণ হয়েছিল। তাঁর পরে ইমাম হাসান (রা.) খলিফা হিসেবে ৪০ হিজরির রমযান মাসে (৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ছয় মাস খিলাফতের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। এরপর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার স্বার্থে আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে সন্ধি করেন এবং শাসনক্ষমতা তাঁর হাতে ন্যস্ত করেন। আসলে এটি ছিল মহানবি (সা.)-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন। তিনি হাসান (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'আমার এ দৌহিত্র সরদার হবে আর সম্ভবত আল্লাহ তা'আলা তাঁর মাধ্যমে মুসলিমদের দু'টি দলের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন।'

চরিত্র ও দেহসৌষ্ঠব

ইমাম হাসান (রা.)-এর চেহারা ও শরীরের গঠন মহানবি (সা.)-এর পবিত্র শরীরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। একবার হযরত হাসান (রা.) শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিলেন। আবু বকর (রা.) তাঁকে দেখে কাঁধে তুলে নিলেন। বললেন, 'আরে হাসান তো দেখতে মহানবি (সা.)-এর মতো, আলির মতো নয়।' আলি (রা.) একথা শুনে হেসে ফেললেন। আনাস (রা.) বলেছেন, 'হযরত হাসান রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন।'হযরত হাসান (রা.) অনেক বেশি ইবাদাত-বন্দেগি করতেন। ফজরের নামায পড়ার পর তিনি সব সময় সূর্যোদয় পর্যন্ত নামাযের স্থানেই বসে থাকতেন এবং যিকর-আযকার করতেন। তিনি মোট ১৫ বার পায়ে হেঁটে হজ করেছিলেন, কোনো বাহন ব্যবহার করেননি। তিনি একটি কবিতায় বলেছেন,

يَا أَهْلَ لَذَّاتِ دُنْيَا لَا بَقَاءَ لَهَا إِنَّ اغْتِرَارًا بِظِلَّ زَائِلٍ حُمْقُ

অর্থ: ওহে দুনিয়ার ভোগী মানুষ। দুনিয়া তো স্থায়ী নয়, অপসৃয়মান ছায়ায় বিভ্রান্ত হওয়া তো নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা।' (কিতাবুয যুহদ)

জীবনীকারগণ তাঁর মহান চরিত্রের বহু দিক উল্লেখ করেছেন। যেমন: তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, দানশীল, ধৈর্যশীল, গভীর প্রজ্ঞাবান এবং দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর আচরণে সবাই মুগ্ধ হতো। সর্বসাধারণ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত।

একবার হযরত হাসান (রা.) একটি লোককে দোয়া করতে শুনলেন। সে আল্লাহর কাছে ১০ হাজার দিরহাম প্রার্থনা করেছিল। হাসান (রা.) তখনই বাসায় এসে ঐ লোকটিকে ১০ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন।আরেকবার তিনি একটি বাগানে গিয়ে দেখতে পেলেন, একজন দাস রুটি খাচ্ছে এবং নিজের রুটি থেকে একটি কুকুরকেও খেতে দিচ্ছে। তিনি বললেন, 'তুমি কুকুরটিকেও খাওয়াচ্ছ?' দাস বলল, 'ওকে রেখে আমার একা খেতে সংকোচ হচ্ছে।' তখন হাসান (রা.) বললেন, 'তুমি এখানেই থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত যেয়ো না।' এরপর তিনি ঐ বাগানের মালিকের কাছে গিয়ে ঐ বাগান এবং দাসকে কিনে নিলেন। এরপর ফিরে এসে দাসকে মুক্ত করে দিয়ে বাগানটিও তাকে দান করলেন। সেই দাস অভিভূত হয়ে তখনই বাগানটিকে আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিল। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

আরেকবার হযরত হাসান ইবনে আলি (রা.) একটি খচ্চরে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একদল দরিদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। তারা মাটিতেই খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খাচ্ছিল আর লোকদের কাছে ভিক্ষা করছিল। হযরত হাসানকে দেখে তারা বললো, 'হে রাসুলুল্লাহর সন্তান! আসুন আমাদের সঙ্গে নাশতা করুন।'

হযরত হাসান (রা.) তখনই বাহন থেকে নেমে পড়লেন এবং মাটিতে বসেই তাদের সঙ্গে মাটিতে ছড়ানো খাবার খেলেন। এরপর বললেন, 'তোমাদের দাওয়াত কবুল করেছি। এবার আমার দাওয়াত কবুল করতে হবে।' এরপর একটি সময় তাদের সবাইকে তিনি ডাকলেন এবং অনেক মূল্যবান খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এবারও তিনি তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেলেন।

ইন্তিকাল

হযরত হাসান (রা.)-কে একদল অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী বিষ খাইয়েছিল। এই বিষক্রিয়ার প্রভাবে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মদিনা মুনাওয়ারায় শাহাদত বরণ করেন। সেদিন মসজিদে নববিতে আবু হুরায়রা (রা.) কান্নারত অবস্থায় চিৎকার করে সমবেত জনতাকে বলেন, 'ওহে মানুষ! নবিজীর (সা.) প্রিয়তম ব্যক্তি আজ ইন্তিকাল করেছেন। তোমরা কাঁদো!' জানাযা শেষে হযরত হাসান (রা.)-কে জান্নাতুল বাকিতে তাঁর মা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.)-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়।

 

Content added By
Promotion